Download Screen Reader

ডিজিটাল সেন্টার বদলে দিয়েছে লাভলী রানির জীবনের গল্প

Date: 11 December, 2022

Source : dhakapost.com

Reading Time: 1 Minute

11 December, 2022 ·
Source : dhakapost.com
· Reading Time: 1 Minute

ডিজিটাল সেন্টার বদলে দিয়েছে লাভলী রানির জীবনের গল্প

ডিজিটাল সেন্টার বদলে দিয়েছে লাভলী রানির জীবনের গল্প

রংপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান হরিদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের। প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার মানুষের এ ইউনিয়নে অধিকাংশের পেশা কৃষি। পাশাপাশি রয়েছেন ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, দিনমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। একসময় নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকা এ ইউনিয়নের মানুষরা এখন সব ধরনের ডিজিটাল সেবা পাচ্ছেন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে। এই ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে লাভলী রানি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একইসঙ্গে চাকরি দিয়ে সাফল্য এনে দিয়েছেন আরো কয়েকজনের জীবনে।

এই ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে যেমন বদলে গেছে লাভলী রানির জীবনের গল্প, তেমনি এলাকাবাসী ঘরের কাছেই পাচ্ছেন সব ধরনের ডিজিটাল সেবা। ঘাত-প্রতিঘাত, মানুষের কটুকথা কানে না তুলে উচ্চ মাধ্যমিকের পর ২০১০ সালে ডিজিটাল সেন্টারে কাজ শুরু করেন লাভলী রানি।

পরিবারের বড় মেয়ে, এদিকে বাবার ক্যান্সার। আয় উপার্জনের পথ বন্ধ অবস্থায় তিনি জানতে পারেন সরকারের ডিজিটাল সেন্টারের বিষয়টি। কারো কথায় কান না দিয়ে হয়ে যান ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা। প্রথম দিকে একেবারে নামমাত্র টাকা আয় হতো (বিভিন্ন সেবার ওপর নেওয়া হয় সার্ভিস চার্জ) ডিজিটাল সেন্টার থেকে। তবুও মনোবল হারাননি তিনি। নিয়মিত ছুটে গেছেন গ্রামে গ্রামে, মানুষকে বুঝিয়েছেন ডিজিটাল সেন্টারের সুফল সম্পর্কে, সেবা কীভাবে পাওয়া যায়, কি ধরনের সেবা পাওয়া যায়; এমন বিভিন্ন বিষয়ে। জীবনযুদ্ধে এমন সংগ্রামের পর বদলে গেছে তার পথচলা। বর্তমানে তিনি ডিজিটাল সেন্টারের একজন সফল নারী উদ্যোক্তা, সেখানেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন আরো ৭/৮ জনের (নারী-পুরুষ)।

 

 

জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে লাভলী রানি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর বড় সন্তান হিসেবে পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়ে। চাকরির জন্য চেষ্টা করেও মেলাতে পারিনি। পরে সন্ধান পাই সরকারের ডিজিটাল সেন্টারের। যোগাযোগ করে হরিদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা হই, প্রথম দিকে কেউ আসতো না সেবা নিতে, আমি নিজেই গ্রামে গ্রামে গিয়েছি মানুষকে বুঝিয়েছি ডিজিটাল সেন্টারের সেবার বিষয়টি। এক পর্যায়ে বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। সংসার তখন পুরোপুরি আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেলো। কাজ আমাকে করতেই হবে, সংসার চালানোর জন্য, বাড়তে থাকলো আমার জীবনযুদ্ধ।

বিয়ে হলো, বাচ্চা হলো, এদিকে দুর্ঘটনায় আমার স্বামী পা হারালেন, এখন তিনি আর কিছু করেন না। বর্তমানে এই সংসারেরও পুরো দায়িত্ব আমার কাঁধে। এতকিছুর মধ্যেও লেখাপড়া চালিয়ে গেছি। কিছুদিন আগে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি। ডিজিটাল সেন্টারের শুরুতে সংগ্রামের কারণে এখন আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না, আমি আজ স্বাবলম্বী। নিজেই ডিজিটাল সেন্টার পরিচালনা করি, দুই সংসারও পরিচালনা করি।

ডিজিটাল সেন্টারের শুরুর দিকের প্রসঙ্গ টেনে এ উদ্যোক্তা বলেন, অনেক সময় সারাদিনের কাজ শেষে ৩০ টাকাও বাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম না। এখন ৭/৮ জনকে আমি নিয়োগ দিয়েছি এই ডিজিটাল সেন্টারে। প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার পথ নিজে স্কুটি চালিয়ে কর্মস্থলে আসি। এক সময় সমাজের মানুষ কটু কথা বলতো, একজন নারী হয়ে কেন আমি এসব করি। কিন্তু আজ সবাই অনুপ্রেরণা দেয়, প্রশংসা করে।

 

ডিজিটাল সেন্টারে কী ধরনের সেবা দেওয়া হয়? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিজিটাল সেবার আওতায় যেসব কাজ পড়ে এর সবই আমার এই সেন্টারে দেওয়া হয়। সবচেয়ে বেশি গ্রাহক আসে জমির পর্চা, দলিলের নকল, ই-নামজারি, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা ভাতা, নাগরিক-দাপ্তরিক আবেদন, চাকরির ফরম, ভর্তির আবেদন, জন্ম নিবন্ধন, ইউপির কর ইত্যাদির বিষয়ে। এগুলোর পাশাপাশি ছবি, ই-মেইল দেওয়া, বিদ্যুৎ বিল, কম্পিউটারের কাজের জন্য প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে এখানে। এক সময় এসব সেবা কেউ নিতে না এলেও এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেবাগ্রহীতার ভিড় লেগে থাকে।

জানা গেছে, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের সেবা কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দোরগোড়ায় দ্রুত, স্বচ্ছতার সঙ্গে, হয়রানি ছাড়া ও স্বল্পমূল্যে সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় এটুআই কাজ করছে। এটুআই এর বিভিন্ন উদ্যোগের সেবা সহজ করার মাধ্যমে সরকারি সেবা নেওয়ার সময়, খরচ এবং যাতায়াতের সাশ্রয় হয়েছে, যার ফলে জনগণ আরও বেশি সেবা নিতে আগ্রহী হচ্ছেন। সাধারণ তথ্য যেগুলো নিতে তাদেরকে বাস ভাড়া, রিকশা ভাড়া এবং পায়ে হেঁটে অফিসগুলোতে যেতে হতো, এখন তা অনলাইনে নিতে পারছেন। সরকারি সেবা নিয়ে এই প্রক্রিয়া থেকে আরও বেশি রাজস্ব আয় সম্ভব হচ্ছে, যা উন্নয়নের অন্যান্য ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়তা করছে।

হরিদেবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মল্লিকা রানি। তিনি দুই সন্তানের জননী। কাজের জন্য স্বামী বাইরে থাকায় তিনিই তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম নিবন্ধন আবেদন করতে এসেছেন ডিজিটাল সেন্টারে। মল্লিকা রানি বলেন, আমার প্রথম সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে খুবই ভোগান্তি হয়েছিল। অনেক দিন ঘুরতে হয়েছে, উপজেলায় যেতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমার ইউনিয়নেই ডিজিটাল সেন্টার আছে। এখানে এসে খুব দ্রুত আবেদন করে দিল তারা। কোনো ঝামেলা নেই, দূরে যাওয়াও লাগল না, ঘরের কাছে লাভলী দিদির ডিজিটাল সেন্টারে এসে মুহূর্তেই সেবা পেয়ে গেলাম।

 

 

জমির দলিলের নকল তুলতে এসেছেন আক্তার হোসেন। সদরে গিয়ে আগে ভূমি অফিসে ঘুরতে হতো দিনের পর দিন, অভিযোগ জানিয়ে তিনি বলেন, আমি জমির দলিলের নকল তুলতে এখানে এসেছি, খুব অল্প টাকায় শুধু সরকারি ফি দিয়ে এই জমির দলিলের আবেদন করলাম। কিন্তু একই কাজ করতে আমাকে আগে জেলা শহরের ভূমি অফিসে যেতে হতো, ঘুরতাম দিনের পর দিন। দালাল ধরে হাজার হাজার টাকা দিয়ে এই কাজ করতে হতো। কিন্তু এখন বাড়ির কাছে এই ডিজিটাল সেন্টার থেকে আমি এই সেবা পেয়ে গেলাম। আমার মতো হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ডিজিটাল সেন্টার থেকে তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন নামমাত্র খরচে, কোনো রকমের ভোগান্তি ছাড়া।

এটুআইয়ের কমিউনিকেশনস অ্যান্ড আউটরিচ কনসালটেন্ট আদনান ফয়সাল বলেন, জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৮ হাজার ৮০৫টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ৩৫০টিরও বেশি সেবা দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার নাগরিকদের যে সেবা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নিতে হতো, কিন্তু ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে সহজে কম সময়ে ও কম খরচে ডিজিটাল সেন্টার থেকে তারা সে সেবা নিতে পারছেন। জনগণের দোড়গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃত। ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এরইমধ্যে নাগরিকদের প্রায় ৮০ কোটিরও বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ১৬ হাজার ৪০০ বেশি উদ্যোক্তা ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে নাগরিকদের সেবা দেওয়ার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। এরমধ্যে ৫ হাজার ২০০ বেশি নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, এটুআই এর বিভিন্ন উদ্যোগের সেবা সহজ করার মাধ্যমে সরকারি সেবা গ্রহণের সময়, খরচ এবং যাতায়াতের সমস্যা দূর হয়েছৈ। যার ফলে জনগণ আরও বেশি সেবা নিতে আগ্রহী হচ্ছেন। সাধারণ তথ্য যেগুলো নিতে তাদেরকে বাসভাড়া, রিকশাভাড়া এবং পায়ে হেঁটে অফিসগুলোতে যেতে হতো, এখন তা অনলাইনে নিতে পারছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


RELATED POSTS